দেশের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিতে জড়িত। ঘুষ লেনদেনে শীর্ষে রয়েছে পাসপোর্ট অফিস। আর ঘুষ ও দুর্নীতির উভয় অপকর্মে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। তবে ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ বেশি হয়েছে বিচারিক সেবা খাতে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘সেবা খাতে দুর্নীতি :জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল বুধবার ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির পক্ষ থেকে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ১৯৯৭ সালে শুরু হয়ে এ নিয়ে নবমবারের মতো দেশের সেবা খাতের দুর্নীতিবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করল টিআইবি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে সেবা খাতের দুর্নীতিবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেটির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, ওই সময়ের চেয়ে এবার দুর্নীতি ও ঘুষ- উভয়ের মাত্রাই বেড়েছে। ২০১৭ সালে সাড়ে ৬৬ শতাংশ খানাকে (পরিবার) ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছিল। ২০২১ সালে তা বেড়ে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রতিটি খানাকে গড়ে ঘুষ দিতে হয়েছিল ৫ হাজার ৯৩০ টাকা। ২০২১ সালে তা হয়েছে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা। এবার মাথাপিছু ঘুষের পরিমাণ ৬৭১ টাকা। ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে মোট ঘুষ ছিল ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এবার মোট ঘুষ ১০ হাজার ৮৩০ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা গত জরিপের চেয়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, যে কোনো অফিসের শীর্ষকর্তা দুর্নীতি না করলেও প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে অধীন কর্মচারী ও ব্যক্তিরা দুর্নীতি করতে পারেন। বিচার বিভাগের ব্যবস্থাপনায় এই দুর্বলতাটা প্রকট এবং সে কারণেই বিচারিক খাতে বিরাট অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের চিত্র টিআইবির গবেষণায় উঠে এসেছে, যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।
তিনি বলেন, বহু বছর ধরেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতা বাড়লে, সেটা হবে ওই বিভাগের জন্য আরও বড় সংকট।
টিআইবির প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতি প্রসঙ্গে সাবেক আইজিপি একেএম শহুদুল হক সমকালকে বলেন, ‘টিআইবির প্রতিবেদন অমূলক মনে করব না। সেবা পেতে হলে নাগরিকদের কষ্ট স্বীকার করতে হয়, টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়- এটা বাংলাদেশের বাস্তবতা। কম-বেশি তো হচ্ছেই।’ তবে এ ব্যাপারে পাসপোর্ট বিভাগের সাবেক ও বর্তমান কোনো কর্মকর্তা কথা বলতেই রাজি হননি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রতিবারই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকারের সংশ্নিষ্ট পক্ষ থেকে সমালোচনা করা হয়। আমরা জরিপের সব মানদণ্ড অনুসরণ করেই জরিপ পরিচালনা করি। অতীতের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অতীতেও টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে তারা সমালোচনা করেছে। টিআইবির প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। অনেক নিয়মও করা হয়েছে। এতে কিছু খাতে দুর্নীতি কমেছেও।
টিআইবি জানায়, আন্তর্জাতিক মানের আট গবেষকের তত্ত্বাবধানে এই জরিপ তৈরি করা হয়। তথ্যের বিবেচ্য সময় ছিল ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর। ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৮ মার্চ এই সময়ের মধ্যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপের আওতা ছিল ঘুষ, জোর করে অর্থ আদায়, আত্মসাৎ, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি ও প্রভাব বিস্তার, সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, ভূমিসেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১৭টি সেবা খাতের ওপর জরিপ চালানো হয়। আটটি বিভাগীয় শহরের মোট ১৫ হাজার ৪৫৪টি খানার ওপর জরিপ করা হয়। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলের খানা ছিল ৯ হাজার ৬৫২টি। শহরাঞ্চলের খানা ছিল ৫ হাজার ৮০২টি। সার্বিকভাবে দৈবচয়নের মাধ্যমে খানাগুলো নির্বাচন করা হয়। এর মধ্যে নারী ছিলেন ৪৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ। পুরুষ ৫০ দশমিক ২১ শতাংশ। তৃতীয় লিঙ্গের ছিল দশমিক ০২ শতাংশ। ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন ৮৯ শতাংশ আর হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৯ দশমিক ১ শতাংশ। অন্য ধর্মের ছিলেন ১ দশমিক ৯ শতাংশ।
টিআইবির গবেষক ফারহানা রহমান ও মোহাম্মদ নূরে আলমের উপস্থাপন করা প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামের ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ খানা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার মাধ্যমে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। শহরে তা ৭৫ দশমিক ২। পাসপোর্টে গ্রামাঞ্চলের ৮২ দশমিক ৯ শতাংশ আর শহরে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বিআরটিএতে গ্রামের ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ আর শহরে তা ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এতে দেখা যায়, শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছে। একইভাবে শিক্ষিত খানার চেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছে অল্প শিক্ষিত খানা। প্রতিবন্ধী খানার দুর্নীতির শিকার হওয়ার চিত্রও তুলনামূলক বেশি। মধ্যবয়সীদের চেয়ে বেশি বয়সী খানাও তুলনামূলক বেশি দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার হয়েছে।
সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত ও ঘুষের খাত :জরিপে সাতটি খাতকে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর শীর্ষে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা; এ খাতে ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার আর ঘুষের শিকার ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে পাসপোর্ট; এ খাতে ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ দুর্নীতির শিকার আর ঘুষের শিকার ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে বিআরটিএ; এ খাতে দুর্নীতির শিকার ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ আর ঘুষের শিকার ৫০ দশমিক ২ শতাংশ। বিচারিক সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ আর ঘুষের শিকার ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ। স্বাস্থ্য (সরকারি) খাতে দুর্নীতির শিকার ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ আর ঘুষের শিকার ৬ দশমিক ২ শতাংশ। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান খাতে দুর্নীতির শিকার ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ আর ঘুষের শিকার ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ভূমিসেবা খাতে দুর্নীতির শিকার ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ আর ঘুষের শিকার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ।
ঘুষের পরিমাণ কোন খাতে কত :গবেষণার তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি ঘুষ লেনদেন হয়েছে বিচারিক সেবা খাতে, সেটা ১ হাজার ৬০৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ১ হাজার ৪৮৮ কোটি ৮০ লাখ, ভূমিতে ১ হাজার ৩৩৬ কোটি ৮০ লাখ, বীমা খাতে ৯৩২ কোটি ৫ লাখ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৭৫৬ কোটি ৪০ লাখ, পাসপোর্টে ৬৮৪ কোটি ৪০ লাখ, বিআরটিএতে ৬৪০ কোটি ৪০ লাখ, বিদ্যুৎ খাতে ৫২০ কোটি ৩০ লাখ, গ্যাসে ৪২০ কোটি ২০ লাখ, শিক্ষায় (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) ২১৮ কোটি ১০ লাখ, স্বাস্থ্য খাতে ১৯২ কোটি ১০ লাখ, ব্যাংকিংয়ে ৯৬ কোটি ১০ লাখ, কর ও শুল্ক্কে ৯২ কোটি ১০ লাখ, এনজিও খাতে ২৪ কোটি, জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ৮ কোটি এবং কৃষিতে ৪ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। অন্যান্য খাতে ঘুষ লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মত :জরিপে অংশগ্রহণকারীর ৭২ দশমিক ১ শতাংশ মনে করেন, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। তারা ঘুষ দেন হয়রানি বা ঝামেলা এড়াতে। খানাপ্রধানের প্রতিবন্ধিতা থাকলে দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার হওয়ার প্রবণতা বেশি। ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা কম দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৫৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সীরা। দুর্নীতির শিকার হলেও অভিযোগ করেননি ৭৯ দশমিক ২২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ অভিযোগ করেননি ঝামেলা বা হয়রানির ভয়ে। সব খানেই দুর্নীতি- তাই অভিযোগ করার প্রয়োজন বোধ করেননি ৪৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সাড়ে ১৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তবে ৭২ শতাংশ অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
টিআইবির সুপারিশ :দুর্নীতি থেকে উত্তোরণে টিআইবি ১০ দফা সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের অবস্থান, পরিচয় ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, এ ক্ষেত্রে বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সক্রিয় ভূমিকা পালন করা, দুর্নীতি রোধে সেবাদান প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড করা, সেবাদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা করা, যেসব খাতে জনবলের ঘাটতি রয়েছে সেটা দূর করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও অংশগ্রহণ বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে সব পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সার্বিকভাবে সেবা খাতের দুর্নীতির এই চিত্র উদ্বেগজনক। ছোট দুর্নীতির মাত্রা এত ব্যাপক হলে বড় প্রকল্প ও বড় কেনাকাটায় দুর্নীতির মাত্রা আরও বেশি বলেই ধারণা করা যায়। দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা সরকারের কাছে আছে। তবে বাস্তবে সেগুলোর প্রয়োগ দেখা যায় না। সুত্র: সমকাল
পাঠকের মতামত